হাসনের স্মৃতিধর
বিদ্যাময় সরকার
ছোটবেলায় পাড়াগাঁয়েও প্রায় সব মানুষের মুখেই হাসন রাজার গান শুনতাম। বাবা মাঝে মাঝেই গাইতো " বাউলা কে বানাইলো রে.... হাসন রাজারে বাউলা কে বানাইলো " লোকে বলে ও বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার ।
দাদা গাইতো ; " মাটির ও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে, কান্দে হাসন রাজার মন ময়নায় রে....."
তন্মধ্যে বেশ প্রচলিত ছিল ;"লোকে বলে ও বলে রে "
এই গানটা। কারো কারো মুখে হাসনের যশকীর্তি শুনতাম। উড়ো উড়ো শুনেছিলাম উনি নাকি যৌবনে বেশ সৌখিন আর রূপবান ছিলো। চরিত্রটা ও বুঝি কলুষিত ছিলো। তখন এসব ভালো বুঝতাম না। এখন ভাবি, রাজার শিল্পের প্রতি ঝোঁক থাকলেও মনটা শৈল্পিক গুনে গড়া ছিলো না।
প্রথম জীবনে রাজা বখাটে ছিলো ঠিক। পরে শোধরে গিয়েছিল। একবারে সাধক হয়ে গিয়েছিল।
অনেকে বলে ;একবার ঘূর্ণিঝড়ে অনেক পশুপাখি আর মানুষ মারা যায়। এই করুন পরিস্থিতি হাসনের মনে দাগ কাটে। ফলে, মনের গতিপথ অন্যদিকে মোড় নেয়।
আবার অনেকে বলে ; বর্ষা হলেই হাসন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বজরায় চড়ে বেরিয়ে পড়তো। নর্তকীদের নৃত্য সমান তালে সরাব পান।
সঙ্গীত সাধনাও চলতো। ওটাই ছিলো আসল। আসলেই রাজা সংঙ্গীতানুরাগি ছিলো। তার আরেকটা মস্ত গুন ছিলো ; নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতো, তাদের নৌকায় যুবতী মেয়ে থাকতো। জোর করে তুলে আনতো হাসনের লোক। একদিন হাসনের মা যুবতীর বেশে বোরকা পড়ে নৌকায় চড়ে যাচ্ছিলো। যাওয়াটা মূলত হাসনের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য।
হাসনের লোক বোরকা পড়া যুবতীকে তুলে আনলো। বোরকা তুলতে হাসনতো দাত-কপাটি লাগার জোগাড়।
এরপর থেকে হাসন রাজা এরম বদমাইশি ছেড়ে দেয়।
সবটুকুই লোকমুখে শোনেছিলাম। এর সত্যতার পাল্লা কতটা ভারী। সেসব পরখ করার ক্ষমতা ছিলো না।
হাসনের লেখা গুলো তখন যেমন কদর ছিলো তা এখনো অটুট রয়েছে।
ধান কাটতে, মাছ ধরতে, মাঠে-ঘাঠে সবখানে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো গানগুলো।
নিতান্ত দরিদ্র ঘরের ছেলে হিসাবে বইয়ের সাথে যোগাযোগ থাকাটাকে নিজের সৌভাগ্য মনে করি। নয়তো হাসন বা তার মতো মনীষীদের গুরুত্ব কখনোই বুঝতে পারতাম না।
কলেজে পড়ি তখন বাউলগান ও বাউলদের জীবন নিয়ে জানার এক তীব্র আকাঙ্খা জন্ম নেয় মনে। হাসন রাজার গান যতরকম সোর্স থেকে সম্ভব সংগ্রহ করে শুনতাম। গানের মাধুর্য উপভোগ করতাম সাথে অর্থের গভীরতা বোঝার চেষ্টা করতাম।
সেইসময় কাব্যি রোগটাও ঝেকে বসেছে মাথায়। লেখালেখি করতাম আর স্বপ্ন দেখতাম আমার লেখা পত্রিকায় বেরিয়েছে। আর আমি বন্ধুদের উছ্বাশিত হয়ে তাই দেখাচ্ছি।
কলেজের ছুটিতে সেবার বাড়িতে এসেছিলাম। মনে ভাবলাম সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করে গঞ্জে যাই না কেনো লেখাগুলো নিয়ে৷ যদি কোনো সুবিধা করতে পারি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
রওনা হলেম গঞ্জের উদ্দেশ্য। গাড়ি থেকে হঠাৎ একজায়গায় চোখ আটকে গেলো। ফটকের সেখানটায় লেখা " হাসন রাজার মিউজিয়াম "।
তৎক্ষনাৎ ঠিক করে ফেললাম ; কাজ শেষ করে মিউজিয়ামটা ঘুরে আসতেই হবে।
সন্ধ্যার কিছু আগে মনখারাপ করে বেরিয়ে আসলাম পত্রিকা অফিস থেকে। ৩ঘন্টা টায় বসে থাকার পর জানতে পারলাম। সম্পাদক নাকি একটা জরুরি মিটিংয়ে আটকে গেছে। ফিরতে রাত ন'টা বাজতে পারে। আমি যে মেনুস্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছিলাম তার উপর আমার নাম্বার লিখে জমা করে দিলাম।
যাইহোক, লেখা প্রকাশ করতে পারলাম না তো কি হয়েছে। পত্রিকা কিভাবে বানায় তাতো দেখে এলাম এটাই বা কম কিসে। এ জিনিস এর আগে কখনো দেখি নাই।
রাস্তায় বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। রিকশার চালক আধবয়সী, পান খায়, কম কথা বলে। নাম মনসূর আলী।
উনারে জিনিস করলাম মিউজিয়াম কতদূরে?ভাড়া কত? মনসূর ভাঙা গলায় জবাব দিলো - বেশি দূরে নেই, সুরমার পাড়ে। ওখানে যেতে ভাড়া ২০ টাকা লাগে। রিকশায় উঠে বললাম - আচ্ছা চলো। রিকশায় উঠে গা এলিয়ে দিয়ে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে অবসন্ন হয়ে পড়লাম। এই সুরমা নদীর মমতায় কবি দিলওয়ার বড় হয়েছেন। তার প্রতিদানে গুন কীর্তন করে গেছেন সুরমার। তারপর ও কোথায় যেন কম হয়ে যায়। রিকশা সুরমার একপাশে একটা গলি ধরে চলছে । গলিটা একেবেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এই শীতের সন্ধ্যায় নদীর পাড়ের ইলেকট্রিক বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। নদীর ঠান্ডা হওয়া এসে গায়ে শুরশুরি দিচ্ছে। সরু গলি পেরিয়ে মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ আছসে।
এমব অনূভুতি কেবল বাংলার জমিনেই পাওয়া যায়।
সামান্য একটু ফাঁকা জায়গায় রিকশা থামলো। লোহার জীর্ণ একখানা ফটক, ফটক থেকে আধভাঙ্গা পাকা রাস্তা গিয়ে ঠেকছে মিউজিয়াম অবধি।
মিউজিয়ামের পাশে একটা টিনের ঘর ছিলো লম্বালম্বিভাবে। বাকি জায়গায় সবুজ দূর্বায় ঢাকা। একটা মহিলা ঐখানে খড়কুটো দিয়ে আগুন করছে।
এইটুক বোঝা যায় মিউজিয়ামটি অবস্থাপন্ন না। অবস্থাপন্ন না যদিও এটাকে মিউজিয়ামের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা বিবেচনার কাজ হবে না। যুগ-যুগান্তরে এই মিউজিয়াম ও অন্যগুলোর মতোই গুনীজনের স্মৃতিধারক হবে, কালের সাক্ষী হয়ে রবে। শতযুগ পূর্বের সমাজেও মানুষ বিচরণ, পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করতে পারবে।
টিকিট কিনে মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। শোকেসে হাসনরাজার ও তার পরিবারবর্গের ফটো। বিভিন্ন দলিল। কয়েক সারিতে শোকেস রয়েছে। তারই এক সারিতে হাসনের ব্যবহৃত জিনিস পত্র।
যেগুলো আমারে খুব আকৃষ্ট করেছিলো। যেমন - পিতলের হুকো, হাসনের ঝাঁঝরওয়ালা পোশাক, ঘি খাওয়ার পাত্র, গানের বাদ্যযন্ত্র, মাথার পাগড়ি, পায়ের খড়ম ইত্যাদি। বেশ কিছু ফটো তুলেছিলাম মিউজিয়ামের ভিতরে ও বাহিরে। কীভাবে জানি ফটোগুলো ডিলিট হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে খুব অনুশোচনা হয়েছিলো। যাঃ বন্ধুদের দেখাতে পারলাম না!
যাইহোক, সেদিন বুঝেছিলাম যেকোনো শিল্পের প্রধান রক্ষক হচ্ছে মিউজিয়াম বা জাদুঘর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন